আইভরি কোস্টের ইতিহাসের এযাবৎকালে আবির্ভূত সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল খেলোয়াড় দিদিয়ের দ্রগবা

দিদিয়ের দ্রগ্‌বা (জন্ম মার্চ ১১, ১৯৭৮) আইভরি কোস্টের একজন ফুটবল খেলোয়াড়। তিনি বিলেতের প্রিমিয়ার লীগে চেলসি দলের পক্ষে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলেন। ২০০৬ সালের ফিফা বিশ্বকাপে তিনি আইভরি কোস্টের জাতীয় দলে অংশগ্রহণ করছেন।

জন্ম ও শৈশব

দিদিয়ের দ্রগবা ১৯৭৮ সালের ১১ মার্চ আইভরি কোস্টের পুরানো রাজধানী আবিজান শহরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তিনি তার পরিবার ও বন্ধুদের নিকটে “টিটো” নামে পরিচিত ছিলেন। মাত্র পাঁচ বছর রয়সে তিনি ফুটবল খেলোয়াড় হওয়ার বাসনায় তার চাচার নিকটে ফ্রান্সে চলে যান এবং তিন বছর পর আবার নিজ পরিবারের কাছে ফিরে আসেন।


নিজ দেশের গৃহযুদ্ধ থামিয়েছিলেন যে ফুটবলার

রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ। ভাইয়ে ভাইয়ে লড়াই। হীন রাজনৈতিক কারণে রাষ্ট্রে বিভক্তি। অযথা রক্তপাত। এমন একটা পরিস্থিতি আফ্রিকার অন্যতম সমৃদ্ধ রাষ্ট্র আইভরি কোস্টের ভবিষ্যৎকে একটা সময় করে তুলেছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষমতাধর রাষ্ট্র, জাতিসংঘ প্রমুখের আহ্বান, অনুরোধ যখন ব্যর্থতায় পর্যবসিত, তখনই ফুটবল, হ্যঁা ফুটবলই এক করে দিয়েছিল আইভরিয়ান জাতিকে। গৃহযুদ্ধ থামিয়ে শান্তির পথে দেশটিকে নিয়ে যেতে ফুটবলই রেখেছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আর যাঁর কারণে ফুটবল এত বড় একটা কাজ করতে পেরেছিল তিনি আর কেউ নন খোদ দিদিয়ের দ্রগবা।


আইভরি কোস্টের ইতিহাসের এযাবৎকালে আবির্ভূত সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল খেলোয়াড় এই দ্রগবা। কেবল ফুটবল বললেও কম বলা হয়, দেশটির ক্রীড়া ইতিহাসেই কিংবদন্তিতুল্য মর্যাদা তাঁর। তিনি আইভরি কোস্টে কতটা জনপ্রিয়, তার সবচেয়ে বড় নমুনা, দেশটির এক ক্রান্তিকালে তিনি তাঁর দেশকে বাঁচিয়েছিলেন খাদের একেবারে প্রান্তসীমা থেকে। তাঁর আহ্বানেই মুখোমুখি বিদ্রোহী ও সরকারি বাহিনী অস্ত্র ফেলে দিয়ে মেতেছিল ফুটবলের সুধায়। বিপর্যয়ের হাত থেকে একটি দেশকে রক্ষা করতে ফুটবল কিংবা দিদিয়ের দ্রগবার মতো ব্যক্তিত্বরা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন, তার সবচেয়ে বড় নজির বোধ হয় এটিই।
২০০২ সালের দিকে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে আইভরি কোস্ট। বিদ্রোহী বাহিনী দখল করে নেয় দেশটির একাংশ। রাজধানী আবিদজান ও এর পার্শ্ববর্তী কিছু অঞ্চলে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে সরকারি বাহিনী। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেই ২০০৫ সালের অক্টোবরে আফ্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে ২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে আইভরি কোস্ট। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েই আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে গোটা দেশ। কিছু সময়ের জন্য হলেও যুদ্ধ ভুলে বিবদমান পক্ষগুলো বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জনের উৎসবে মেতে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে ফুটবলের আবেগ ব্যবহার করে নিজ দেশের গৃহযুদ্ধ থামাতে এগিয়ে আসেন দিদিয়ের দ্রগবা।
দ্রগবা আইভরি কোস্টে অসম্ভব জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব। তাঁর জনপ্রিয়তার কোনো কমতি নেই কারও কাছেই। চকলেট থেকে শুরু করে মোবাইল ফোন—আইভরি কোস্টের বাজারজাতকৃত প্রায় প্রতিটি পণ্যের প্রসারেই ব্যবহৃত হয় এই ফুটবলারের ইমেজ। ২০০৬ বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার দিনই। স্টেডিয়ামের সাজঘরে জাতীয় দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে পাশে নিয়ে দ্রগবা দেশবাসীর উদ্দেশে এক আবেগঘন বক্তৃতা দিয়েছিলেন। নিজেদের বিশ্বকাপ-যোগ্যতা অর্জনের কথা উল্লেখ করে দ্রগবা বিবদমান পক্ষগুলোকে গৃহযুদ্ধ থামানোর অনুরোধ জানিয়েছিলেন। জাতীয়তাবোধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে দেশের সেই দারুণ অর্জনটিকে ঐক্যবদ্ধভাবে উদযাপনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। দ্রগবার আহ্বানে কাজ হয়েছিল। তাঁর এই ঘোষণার ফলে যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছিল বিবদমান পক্ষগুলো। সব বিভেদ-হিংসা ভুলে মেতে উঠেছিলেন বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো পা রাখার আনন্দেময় উৎসবে।
এর কয়েক দিন পরে আরও একটি অনন্য ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন দ্রগবা। আফ্রিকান নেশনস কাপে মাদাগাস্কারের বিপক্ষে একটি ম্যাচ বউয়াকেতে খেলার অনমুিত আদায় করে নিয়েছিলেন দ্রগবা। বউয়াকে ছিল বিদ্রোহী বাহিনীর মূল ঘাঁটি। আবিদজান থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বউয়াকেতে আয়োজিত মাদাগাস্কারের ওই ম্যাচটিই ছিল আইভরি কোস্টের গৃহযুদ্ধ থামিয়ে দেওয়ার মূল মঞ্চ। সেদিন বিবদমান দুই পক্ষের নেতারাই পাশাপাশি বসে উপভোগ করেছিলেন মাদাগাস্কারের বিপক্ষে ম্যাচ। সরকারি পুলিশ বাহিনী ও সেনারা দায়িত্ব পালন করেছিল বউয়াকে স্টেডিয়ামের শান্তি-শৃঙ্খলা বিধানে।
একজন খেলোয়াড় মাঝেমধ্যে তাঁর খেলোয়াড়ি সত্তার চেয়েও বড় হয়ে উঠতে পারেন।

আইভরি কোস্টের সর্বকালের সেরা ফুটবলার হয়ত তিনিই।

দিদিয়ের দ্রগবা আইভরি কোস্টকে এনে দিয়েছেন বহু সাফল্য। শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও দেশের জন্য আছে তার অনেক অবদান।

Leave a comment